Header Ads Widget

নারায়নগঞ্জের ঐতিহাসিক কদম রসুল দরগাহ

ঘুরে আসতে পারেন নারায়নগঞ্জের ঐতিহাসিক কদম রসুল দরগাহ


দরগাহটি নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান যা বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত। বন্দরের নবীগঞ্জ এলাকাতে এই কদম রসুল দরগাহটি বিশাল জায়গা নিয়ে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু মাটির টিলায় এটির অবস্থান। দরগাহ শরীফ সামনে সুন্দর কারুকাজ খচিত সুউচ্চ দোতলা তোরণ যা মসজিদ বা মাজারের আদলে রয়েছে। ভিতরে প্রবেশ করতেই বাম দিকে রয়েছে একটি মসজিদ। এই মসজিদে রয়েছে মহিলাদের জন্য নামাজ পড়ার সুব্যবস্থা। ডানদিকে রয়েছে কিছু পাকা কবর। জনশ্রুতি রয়েছে এগুলো কদম রসুল দরগাহর প্রতিষ্ঠাতা মাসুম খান কাবুলীর বংশধরদের কবর। ১২ রবিউল আউয়াল উপলক্ষে এই কদম রসুল দরগাহকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আচারসহ বিরাট মেলার আয়োজন করা হয়। তাছাড়া শবে বরাত, শবে কদর, শবে মেরাজ, ঈদুল আজহা, ঈদুল ফিতরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জাসহ নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠে এই দরগাহের ভবনসহ আশপাশের এলাকা।

কদম রসুল বলতে নবী মুহাম্মদ এর কথিত পায়ের ছাপ কে বোঝায়। আর রাসূল (হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম) এর কদমের ছোঁয়া পড়েছে। পরে সাহাবীগণ পদ চিহ্নিত পাথর গুলো সংরক্ষণ করেন বলে অনেকে দাবি করেন। মক্কা ফেরত অনেকেই এ ধরনের পদচিহ্ন যুক্ত পাথর খন্ড শ্রদ্ধার সঙ্গে এগুলো বিভিন্ন সৌধে বিশেষ করে মসজিদের অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করতেন। এরকম একটি দরগাহ বা সৌধ হল নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন বর্তমান নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগাহ যা পবিত্র কদম রসুল দরগাহ শরীফ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত। সতের শতকের প্রারম্ভে রচিত "বাহারিস্তান-ই-গায়বী" নামক গ্রন্থে লেখক মির্জা নাথান নবীগঞ্জের এই পাথরটির কথা উল্লেখ করেছেন। স্থানীয় ৭০ বছর বয়সের বৃদ্ধ মোতালেব মিয়া জানান, তিনি তার বাবা ও দাদাসহ এলাকার অনেকের মুখেই শুনেছেন এক সাধক মক্কায় হজ্ব করতে গেলে সেখানে তিনি এক উচ্চ মাপের এক সাধকের কাছ থেকে এই পাথরটি উপহার হিসেবে পান। আমৃত্যু এই পাথরটিকে তিনি তার বুকে আগলে রাখেন এবং এখানেই মারা যান। তাই রাসুলের (সা.) প্রতি সম্মান জানাতে এবং সাধকের এই ভালবাসাকে কেন্দ্র করে এখানে এই মাজারটি গড়ে উঠে। 


এখন থেকে প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর আগে দর্শনার্থীগণ এটি খুব সহজেই এটি দেখতে পারতো, এই পাথরে চুমো খেতে পারতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো এত সহজে পাথরটিকে দর্শনার্থীদের সামনে নিয়ে আসা হয় না। এটা এখন একটি কাঁচের বাক্সের ভিতর রাখা আছে এবং কিছু বিশেষ দিনেই এটা বাক্স থেকে বের করে দেখানো হয়।  মূল দরগাহের ভেতরে একটি ধাতব পাত্রে গোলাপ জলে পাথরটি ডোবানো অবস্থায় থাকে। পাথরটি অবশ্য এখন আর পূর্বের অকাট আকৃতিতে নেই। সংরক্ষণের সময়ে পাথরটি কেটে অনেকটা পদাকৃতি করা হয়েছে। দরগাহের আশেপাশে অনেকগুলো কবর ও মাজার শরীফ আছে। কদম রসুল এই পাথরের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে প্রতিদিন বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান দরগাহ জিয়ারত করতে আসেন। 

উৎপত্তি সম্পর্কিত প্রচলিত ইতিহাস

প্রচলিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম মিরাজের রাত্রে বোরাকে উঠবার পূর্বে পাথরে তার পায়ের কিছু ছাপ অঙ্কিত হয়। পরবর্তীতে সাহাবিগণ পদ চিহ্নিত পাথর গুলো সংরক্ষণ করেন বলে অনেকে দাবি করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটি বর্তমানে জেরুজালেমে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া ইস্তাম্বুল,কায়রো এবং দামেস্কে অনুরূপ পাথর সংরক্ষিত আছে। আমাদের বাংলাদেশেও এমন আরো দুটি পাথর রয়েছে, যার একটি আছে চট্টগ্রামে আর অপরটি রয়েছে নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগায়।  ষোল শতকের শেষদিকে মির্জা নাথান কর্তৃক প্রনীত ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাহারিস্থান-ই-গায়েবীর সুত্রে জানা যায় যে, মুঘল সম্রাট আকবর এর বিপক্ষে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী আফগান সেনা প্রধান মাসুম খান কাবুলী নামে সম্ভ্রান্ত রাজা ছিলেন। তিনি বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম সোনারগাঁয়ের ঈশা খাঁর বন্ধু ছিলেন।  তিনি ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে আরব বণিকদের নিকট থেকে বহু অর্থের বিনিময়ে এই মহা মূল্যবান পাথরটি কিনে নেন। এবং এ স্থানে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে এই স্থানটি দর্শন করেন সুবাদার ইসলাম খান, মুঘল সম্রাট শাহজাহানসহ আরো অনেক আমির-ওমরা। সুলতান শুজা এই দরগার জন্য ৮০ বিঘা জমি দান করেন। পরে ঈসা খাঁর প্রোপুত্র দেওয়ান মনোয়ার খান এখানে একটি ইমারত তৈরি করেন। কিন্তু সেই ইমারতও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সে সময় এখানে কীরকম ইমারত ছিল তা জানা যায় না। ঢাকার জমিদার গোলাম নবী পরে ১৭৭৭ থেকে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের (১১৯১ হিজরিতে) দিকে এক গম্বুজ বিশিষ্ট দরগা নির্মাণ করে পাথর খন্ডটি স্থাপন করেন।   এর পরে গোলাম নবীর তৃতীয় পুত্র গোলাম মোহাম্মাদ ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমদিকের দোতলা তোরণটি নির্মাণ করেন।

সত্যতা

প্রথাগত মুসলিমরা এটি স্বীকার করেন না। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় সংরক্ষিত পদ চিহ্ন গুলি বিভিন্ন আকারের। যেখানে একজন মানুষের পায়ের ছাপ একই হওয়ার কথা। কদম রসুল প্রচলিত অর্থে খন্ডের উপরে নবী করিম মুহাম্মাদ এর পায়ের ছাপ, তবে এই কদম রসুল ধারণার উৎপত্তি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ। নাসিরুদ্দিন হোসেন শাহ গৌড়ে প্রথম কদম রসুল ও সংলগ্ন স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণ করলেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা যায় মুঘল আমলে। সমগ্র ভারতবর্ষে কদম রসুলের সংখ্যা ১৪ টি। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে আর একটা মজমপুর গ্রামে, চট্টগ্রামে দুইটা কদম রসুল আছে। কদম রসুলকে মুহাম্মাদের পায়ের ছাপ হিসাবে দাবী করা হলেও মূল ইসলাম ধর্মে এর কোন স্বীকৃতি কিন্তু নেই। এই কারণে ইসলাম ধর্মের উৎপত্তিস্থল মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের কোন নিদর্শন সংরক্ষিত হয়নি এবং ধর্মীয় ভাবেও চর্চিত হয়না।

কিভাবে আসবেন

ঢাকার যে কোন স্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী বা কমলাপুর। গুলিস্তান বা যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে পারবেন এসি বা নন এসি বাসে। বিআরটিসি, আশিয়ান, বন্ধন, উৎসব, সেতু, আনন্দ ইত্যাদি পরিবহনের বাস। ভাড়া পরবে ৪০ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। আর কমলাপুর থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। ভাড়া ১৫ টাকা।

কম-বেশি ১ ঘন্টায় পৌঁছে যাবেন ঢাকা থেকে ২২ কিলোমিটার দূরের নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ বাস বা ট্রেন স্টেশন থেকে নদী পার হয়ে ৩০ টাকায় রিক্সা ভাড়া করে চলে যাবেন কদম রসূল দরগাহ। হাজীগঞ্জ/নবীগঞ্জ গুদারা ঘাট নামলে নৌকা নিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে চলে যান পূর্ব পারে। এখান থেকে কয়েক মিনিটে হেঁটে বা রিক্সা করে ১৫টাকা ভাড়ায় চলে যেতে পারেন কদমরসুল দরগাহ।

এছাড়া ঢাকা থেকে বাসে মদনপুর যেতে পারেন। মদনপুর থেকে শেয়ার সিএনজি বা ইজি বাইকে একবারে কদম রসুল দরগাহ এর সামনে নামিয়ে দিবে।


Post a Comment

0 Comments